সকালে ও রাতে গ্রিন টি খাওয়ার উপকারীতা

সকালে ও রাতে গ্রিন টি খাওয়ার উপকারীতা

সকালে ও রাতে গ্রিন টি খাওয়ার অভ্যস চা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি পরিচিত পানীয়। বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারতসহ এশিয়ার বহু দেশে চা যেন এক অনিবার্য অংশ। তবে সাধারণ দুধ-চিনি মিশ্রিত চায়ের বাইরে আরেক ধরনের চা সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, সেটি হলো গ্রিন টি। এটি কেবল একটি পানীয় নয়, বরং স্বাস্থ্যের জন্য এক অসাধারণ প্রাকৃতিক উপহার। আধুনিক গবেষণা বারবার প্রমাণ করেছে যে গ্রিন টির ভেতরে রয়েছে এমন সব উপাদান, যা মানুষের দেহকে রোগ থেকে সুরক্ষা দেয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং সুস্থ জীবনযাপনে সহায়তা করে।

সকালে-ও-রাতে-গ্রিন-টি-খাওয়ার-উপকারীতা

সকালে ও রাতে গ্রিন টি খাওয়ার অভ্যস এই প্রবন্ধে আমরা গ্রিন টি খাওয়ার উপকারীতা, এর ভেতরে থাকা পুষ্টি উপাদান, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে এর ইতিবাচক প্রভাব, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্ব এবং সঠিকভাবে গ্রিন টি পান করার নিয়ম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

গ্রিন টির উৎপত্তি ও বৈশিষ্ট্য গ্রিন টি তৈরি করার সময় পাতা খুব কম প্রক্রিয়াজাত করা হয়। পাতাগুলো সাধারণত বাষ্পে সেদ্ধ করা বা হালকা ভেজে শুকানো হয়, যাতে প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অন্যান্য উপকারী যৌগগুলো অক্ষত থাকে। এই কারণে গ্রিন টিকে সবচেয়ে স্বাস্থ্যসম্মত চায়ের ধরন বলা হয়।

গ্রিন টির পুষ্টিগুণ গ্রিন টি ভেতরে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বা পলিফেনলস রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ক্যাটেচিনস (বিশেষ করে EGCG – Epigallocatechin gallate)। এছাড়া এতে আছে—ভিটামিন সি, ভিটামিন বি ২,ফ্লোরাইড, অ্যামিনো অ্যাসিড (যেমন এল-থিয়ানিন), মিনারেলস (ম্যাঙ্গানিজ, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম)

এই উপাদানগুলো শরীরের জন্য বিভিন্নভাবে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। গ্রিন টি খাওয়ার প্রধান উপকারীতা- অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের শক্তিশালী উৎস আমাদের শরীরে প্রতিনিয়ত “ফ্রি র‍্যাডিক্যালস” নামে ক্ষতিকর অণু তৈরি হয়। এগুলো কোষের ক্ষতি করে, বার্ধক্য ত্বরান্বিত করে এবং ক্যানসারসহ নানা রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। গ্রিন টির অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ফ্রি র‍্যাডিক্যালস নিস্ক্রিয় করে শরীরকে সুরক্ষিত রাখে।

হৃদ্‌রোগ প্রতিরোধে সহায়ক বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত গ্রিন টি পান করলে খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) কমে এবং ভালো কোলেস্টেরল (HDL) বাড়ে। পাশাপাশি এটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং ধমনীতে চর্বি জমতে বাধা দেয়। ফলে হৃদ্‌রোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।

যাদের মেদ/ভুড়ি তাদের জন্য ওজন কমাতে সহায়ক আজকাল যারা স্বাস্থ্য সচেতন, তারা ওজন কমাতে গ্রিন টিকে অন্যতম সহায়ক পানীয় হিসেবে গ্রহণ করছেন। গ্রিন টির ক্যাটেচিন ও ক্যাফেইন শরীরে ফ্যাট অক্সিডেশন বাড়ায় এবং মেটাবলিজম দ্রুত করে। ফলে ক্যালরি দ্রুত পুড়ে যায় এবং অতিরিক্ত চর্বি জমতে পারে না।

অনেক ক্ষেত্রে ক্যানসার প্রতিরোধে কার্যকর যদিও এটি পুরোপুরি নিরাময় করতে পারে না, তবে গ্রিন টির অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট  ক্যানসার সৃষ্টিকারী কোষের বৃদ্ধি প্রতিরোধ করে। বিশেষ করে স্তন ক্যানসার, প্রোস্টেট ক্যানসার ও কোলোরেক্টাল ক্যানসার প্রতিরোধে গ্রিন টির কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা চলছে।

অনেক  মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বৃদ্ধি গ্রিন টির মধ্যে থাকা ক্যাফেইন ও এল-থিয়ানিন মিলে মস্তিষ্ককে উদ্দীপ্ত করে। ক্যাফেইন মনোযোগ বাড়ায়, আর থিয়ানিন চাপ কমিয়ে প্রশান্তি দেয়। এর ফলে স্মৃতিশক্তি, শেখার ক্ষমতা ও মনোযোগ বৃদ্ধি পায়।

সকালে-ও-রাতে-গ্রিন-টি-খাওয়ার-উপকারীতা


ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক টাইপ-২ ডায়াবেটিসের প্রধান সমস্যা হলো ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স। গ্রিন টির উপাদান ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ায় এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। নিয়মিত গ্রিন টি পান করলে ডায়াবেটিস রোগীরা উপকার পেতে পারেন। দাঁত ও মুখের স্বাস্থ্য গ্রিন টির মধ্যে থাকা ক্যাটেচিন মুখের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে, ফলে দাঁতে ক্যাভিটি হওয়ার ঝুঁকি কমে। এছাড়া এটি মুখের দুর্গন্ধ প্রতিরোধেও সাহায্য করে।রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় গ্রিন টি শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে। এর অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিভাইরাল বৈশিষ্ট্য আমাদের সর্দি-কাশি, ফ্লু এমনকি অন্যান্য সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। বার্ধক্য প্রতিরোধে কার্যকর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকার কারণে গ্রিন টি কোষের ক্ষতি কমায়। ফলে ত্বক দীর্ঘদিন তরুণ থাকে, বলিরেখা কম দেখা যায় এবং চেহারায় সতেজতা বজায় থাকে।

মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি  আধুনিক জীবনের চাপ, উদ্বেগ ও হতাশা অনেকের জীবনে নিত্যসঙ্গী। গ্রিন টির থিয়ানিন মস্তিষ্কে সেরোটোনিন ও ডোপামিন নিঃসরণ বাড়ায়, যা আমাদের মানসিক প্রশান্তি ও সুখানুভূতি প্রদান করে।বৈজ্ঞানিক গবেষণায় গ্রিন টির উপকারিতা বিভিন্ন দেশে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে:জাপানে এক দীর্ঘমেয়াদি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রতিদিন ৫ কাপ বা তার বেশি গ্রিন টি পান করেছেন, তাদের মধ্যে হৃদ্‌রোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।আমেরিকান জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনের এক গবেষণা অনুযায়ী, গ্রিন টি ফ্যাট বার্নিং প্রক্রিয়া ১৭% পর্যন্ত বাড়াতে পারে। চীনের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত গ্রিন টি পানকারীদের মধ্যে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কম। গ্রিন টি খাওয়ার নিয়ম শুধু গ্রিন টি পান করলেই সব উপকার পাওয়া যাবে না, সঠিক নিয়ম মেনে খেতে হবে। গরম কিন্তু ফুটন্ত নয় এমন পানি ব্যবহার করুন (প্রায় ৮০°–৮৫°C)। চা-পাতা বা টি-ব্যাগ পানিতে ২–৩ মিনিট ভিজিয়ে রাখলেই যথেষ্ট। অতিরিক্ত সময় ভিজিয়ে রাখলে তিক্ত স্বাদ আসতে পারে। দিনে ২–৩ কাপ যথেষ্ট; অতিরিক্ত খেলে ঘুমের ব্যাঘাত বা পাকস্থলীতে অস্বস্তি হতে পারে। খালি পেটে না খাওয়াই ভালো; হালকা খাবারের পর পান করা উত্তম। সতর্কতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যদিও গ্রিন টি অত্যন্ত উপকারী, তবে কিছু সতর্কতাও মানতে হবে— অতিরিক্ত গ্রিন টি পান করলে ক্যাফেইনজনিত সমস্যা (হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, অনিদ্রা, মাথাব্যথা) হতে পারে। গর্ভবতী বা স্তন্যদানকারী মায়েদের জন্য বেশি গ্রিন টি খাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। যারা রক্ত তরলকারী ওষুধ (যেমন ওয়ারফারিন) খান, তাদের ক্ষেত্রে গ্রিন টির ভিটামিন কে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।

সকালে গ্রিন টি খাওয়ার অভ্যাস উপকারিতা-সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর শরীরকে সতেজ করে।মেটাবলিজম দ্রুত করে, ফলে সারা দিন ক্যালরি পোড়াতে সহায়তা করে। মনোযোগ ও সতর্কতা বাড়ায়, কাজে উদ্যম দেয়।

সকালে  গ্রিন টি খাওয়ার সতর্কতা একদম খালি পেটে খেলে অ্যাসিডিটি বা অস্বস্তি হতে পারে। তাই হালকা নাশতার পর বা অন্তত এক গ্লাস পানি খাওয়ার পর গ্রিন টি পান করা ভালো।

রাতে গ্রিন টি খাওয়ার অভ্যাস উপকারিতা-দিনের ক্লান্তি কমাতে সাহায্য করে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ঘুমের সময় শরীরকে ভেতর থেকে রিপেয়ার করতে সহায়তা করে। হালকা ডিটক্সের কাজ করে।

রাতে গ্রিন টি খাওয়ার সতর্কতা গ্রিন টিতে ক্যাফেইন আছে, তাই শোবার আগে একেবারে খেলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে।তাই রাতে গ্রিন টি খেতে চাইলে শোবার অন্তত ২–৩ ঘণ্টা আগে খাওয়াই উত্তম।

শেষ কথা:

সবদিক বিচার করলে বলা যায়, গ্রিন টি হলো প্রকৃতির এক অপার দান। এটি শুধু একটি পানীয় নয়, বরং সুস্থতা ও দীর্ঘায়ুর এক মহৌষধ। নিয়মিত ও পরিমিত পরিমাণে গ্রিন টি পান করলে আমরা ক্যানসার, হৃদ্‌রোগ, ডায়াবেটিস, স্থূলতা, মানসিক চাপসহ নানা সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে পারি। তবে অতিরিক্ততার দিকে না গিয়ে পরিমিতভাবে, সঠিক নিয়মে গ্রিন টি খাওয়াই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সুস্থ ও সুন্দর জীবনের জন্য প্রতিদিনের অভ্যাসে তাই গ্রিন টি জায়গা করে নিতে পারে।সকালে: খালি পেটে নয়, হালকা খাবারের পর পান করুন। রাতে: শোবার আগে নয়, বরং রাতের খাবারের কিছু সময় পর খাওয়া ভালো। দৈনিক ২–৩ কাপ যথেষ্ট; তার বেশি খেলে উপকারের বদলে সমস্যা হতে পারে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url